Friday, February 24, 2017

চশমাটা খসে গেলে....

চশমা পড়ি সেই ছোট্ট বেলা থেকে। একেবারে ছোট বয়স থেকেই আমার চোখের সামনে দুটো কাচের টুকরো থাকে সবসময়, অন্তত জাগা অবস্থায়। ৫-৬ বছর বয়সে আমার সেই প্রথম চশমা-পড়া চেহারার বেশ কিছু ছবি আছে এখনো। আমি নাকি সেই চশমা আবার একটু পরপর নাক লম্বা করে, ভ্রূ উঁচু করে এডজাস্ট করতাম। সেটা নিয়ে এখনো প্রায়ই হাসাহাসি হয় বাসায়। সেই চশমাটা এখনো আছে আমার ড্রয়ারে। গোছাতে গিয়ে যখন মাঝে মাঝে হাতে আসে ওটা, কিছুক্ষনের জন্য থেমে যেতেই হয়, হাসি পায়। 

সেই যে চশমা ঝুললো চোখে......


চোখের পাওয়ার কমতে কমতে, আর চশমার পাওয়ার আর দাম বাড়তে বাড়তে এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা রীতিমতো দুঃখজনক। বিশেষ করে বাম চোখটার অবস্থা এতই খারাপ যে এটা লেজার ট্রিটমেন্টের অযোগ্য বলে দিয়েছেন এক ডাক্তার। তবে সবসময় চশমা হাতের কাছে থাকে বলে, এটার অভাব বা আমার শোচনীয়তার পরিমানটা টের পাইনা খুব একটা। তবে যখন টের পাই, বেশ অসহায় লাগে।

এরকম একটা এক্সপেরিয়েন্স হয়েছিল সুন্দরবনে। সেটা ছিল আমাদের আহসানুল্লাহর ব্যাচের ফেয়ারওয়েল ট্রিপ, একশো জনের উপর ছাত্র ছাত্রী নিয়ে। প্রচন্ড exciting সেই ট্রিপ এর কাহিনী লিখেছিলাম আগে একবার। তো সেবার কটকা বীচে, দোস্তদের সাথে সাগরের পানি দাপাদাপিতে ব্যস্ত। খুব সম্ভবত অনিন্দ বললো, ঢেউ আসলে ঢেউয়ের নীচে মাথা দে, মজা লাগে। তাই নাকি? ট্রাই করে দেখা লাগে। মিডিয়াম সাইজের একটা ঢেউ আসতে দেখে ডুব দিলাম, মাথার উপরে ভেঙে পড়ল পানির টিলা। একটু পরেই আবার পানি সরে যেতে লাগলো যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে।ভুল বলেনি, আসলেই মজা। পানির উপর মাথা উঠিয়ে চিন্তা করছি আবার একটা দেয়া লাগে, কিন্তু মনে হলো, কি যেন একটা সমস্যা আছে। Something's not right. বেপারটা বুঝলাম একটু পরেই। আমার চশমা নাই। ঢেউয়ে ভেসে গেছে! আর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বীচে উঠে আসলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ চশমা ছাড়া আমি এতটাই কানা যে রীতিমতো আতঙ্ক কাজ করে। চশমার এক জোড়া স্পেয়ার ছাড়া কখনোই কোনো সফরে বের হয়নি, সেবারও না। তবে সেটা ছিল লঞ্চে, ব্যাগের ভেতর। স্টেইন্ড গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখার মতো বন্ধুদের শুধু ভৌতিক অবয়বগুলো দেখতে লাগলাম, পানিতে নেমে উদ্ভট কিসব যেন করছে। বেশ কিছু পরে লঞ্চে ফিরে আবার 'প্রাণ' ফিরে পেলাম চোখে।

কয়েকদিন আগে আবারো সেই অসহায়ত্বের একটা ছোট ডেমো পেলাম। কাহিনী যদিও সিম্পল। মিরপুরে IELTS ক্লাস নেয়া শেষে এশার নামাজ পড়বো মসজিদে। জামাত শেষ বেশ আগেই। ওযুর সময় আমি সবসময় চশমাটা ঝুলাই পিছন দিকে, মানে দুই কাঁধের মাঝে, জামার সাথে। ওযু শেষে চশমা পেছনে ঝুলিয়ে রেখেই মসজিদে ঢুকলাম। মসজিদের একেবারে সামনে কিছু লাইট ছাড়া বাকিগুলো অফ। পিছনে এক পাশে জুতা রাখার জন্য নিচু হতেই চশমাটা পরে গেল কার্পেটের উপর। ডার্ক লাল রঙের কার্পেট, তার উপর কালো কাজ করা। এদিকে আলো কম কিছুটা। মাথা নিচু করে খুঁজতে লাগলাম। কোনো চিহ্ন নেই। পা দুটোকে সেন্টারে রেখে মাথা ঝুকিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগলাম। No use. পেছনের কিছু মুসল্লি হা করে তামাশা দেখছে, হয়তো করুনা নিয়ে, হয়তো না। আত্মসম্মান তাও কিছু বাকি ছিল তখনো। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে না পেয়ে শেষমেষ যখন হামাগুড়ি দিয়ে হাতড়াতে লাগলাম, তখন সেটাও আর বাকি থাকলো না। তবে বেশিক্ষন এই অপমানজনক পজিশনে থাকতে হলো না, হাতে এসে বাজলো আমার precious চশমা।

পুরো ঘটনাটা খুব অল্প সময়ের, আর তেমন একটা সিগনিফিক্যান্ট কিছুনা, তবুও আমার অনেক হাসি পেলো। বেশ কিছু অনুভূতি খেলে গেল মাথায় একসাথে। প্রথমেই মনে হলো, দুটো স্বচ্ছ কাঁচের টুকরোর উপর আমি কত ডিপেন্ডেন্ট! আর ভাবলাম, আমি তো তাও চশমা পরে ঠিকঠাক দেখি, কত মানুষের তো সেই সুযোগও নেই! 


আর সেই সাথে ভাবলাম, আল্লাহ চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের সম্মানিত করতে পারেন, আবার সাথে সাথেই ছোট করতে পারেন। এই একটু আগেই ক্লাস ভর্তি ছাত্রের সামনে আমার কত পার্ট। আমি খুব ভালো ভাব নিতে পারি, ক্লাসে সেই যোগ্যতার পূর্ণ ব্যবহার করি, ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই তাই বয়সে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও বেশ রেসপেক্ট করে। অথচ তার একটু পরেই, আল্লাহ আমাকে মসজিদের মেঝেতে গাধার মতো চার হাতপায়ে একটু ঘুরিয়ে নিলেন। কোথায় গেল ক্লাসের ঐ স্মার্ট আসিফ স্যার? 

আসলে আমাদের অহংকারের কিছুই নেই। নিজেদের অবস্থার উপরে বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ আমাদের নেই। সর্বাবস্থায় আমরা আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। সেটাই আল্লাহ মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেন। মনে যে করিয়ে দেন সেটাতেও আল্লাহরই শুকরিয়া, উনি তার মানে ভাবছেন আমার কথা? আর তাঁর মনে পড়ানোতেও যে আমাদের মনে পড়বে তাঁর কথা, সেটাও তাঁর ইচ্ছায়। কত মানুষ আল্লাহর দেখানো বড় বড় ইঙ্গিতেও অন্ধ থেকে যায়। আল্লাহ যে আমাকে বাইরের এবং ভেতরের চোখে পুরো অন্ধ করেননি, তাই শুকরিয়া। আল্লাহ আমাদের দৃষ্টিকে আরো স্পষ্ট করে দিন। আমীন।