Showing posts with label Parents. Show all posts
Showing posts with label Parents. Show all posts

Sunday, August 20, 2017

নূরের শহরে (৪) - রহমতে, বৃষ্টিতে, অশ্রুতে ভিজে

আল্লাহর ঘরের নিমন্ত্রণ পাওয়া, তাঁর ঘরেরতাওয়াফের তৌফিক পাওয়া, তাঁর হাবিবের সামনে দাঁড়াতে পারা এমনিতেই ছিল আমার জন্য হঠাৎ পাওয়া অবিস্বাশ্য নিয়ামত, তার উপরে আবার আল্লাহ আমাকে নিয়েছেন বাবা মায়ের সাথে, সুযোগ দিয়েছেন তাদের কিছু খেদমত করার। একদিকে আল্লাহর গুনাহগার বান্দা, অপরদিকে বাবা মায়ের হক আদায়ে ব্যর্থ সন্তান, তারপরেও এতবড় দান আল্লাহর তরফ থেকে, এতো ভালোবাসা বাবা মায়ের কাছ থেকে! কেবল উনাদের থেকেই আসলে আশা করা যায়!

তো এই সফরে বাবা মা যখন মসজিদে যেতেন, বা বাইরে কোনো কাজে, সাথে সাথেই থাকতাম। খাবারের সময় খুঁজে খুঁজে মনমতো খাবার নিয়ে আসতাম হোটেলে। তবে সকালের দিকে বা দুপুরের পরে, যখনিই তারা বিশ্রাম নিতেন, আমি ফুড়ুৎ করে প্রায় উড়ে চলে যেতাম নবীর মসজিদে! হোটেল থেকে নামলেই মসজিদে নববী, ইশ কত খুশির সময় ছিল! এ সময়গুলো আমি চড়ে বেড়াতাম প্রিয় নবীর মসজিদের জমিনে। কিছুটা দ্বীনি শিক্ষা বা উপলব্ধি যাদেরকে আল্লাহ দিয়েছেন, তারা এই মসজিদের মর্যাদা বুঝেন। আরেকটু যারা আগে বেড়েছেন আল্লাহর দিকে, তারা টের পান এই মসজিদের নূর, এখানের রুহানিয়াত। অদৃশ্য জগতের আয়োজন সবার চোখে না পড়লেও, এখানের বাহ্যিক সাজসজ্জা চোখ এড়াবে না কারোরই। এখানের চোখ ধাঁধানো আর্কিটেকচার, ডেকোরেশন, লাইটিং দেখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। সেই সাথে মুসল্লিদের সুবিধার জন্য আছে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার। তবে আমাদের বড়োরা এসব জাঁকজমকের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে নিরুৎসাহিত করেন। করারই কথা। প্রিয় মানুষকে আমাদের চোখে সুন্দর লাগে তার প্রতি মহব্বতের কারণে, আর তার গায়ের অলংকার সেই সৌন্দর্যকে একটু বাড়িয়ে দেয় কেবল। তবে সব আকর্ষণ যদি হয় ওই গলার হারের দিকেই, প্রশংসা যদি হয় শুধু হীরার আংটির, তবে কি সে খুশি হবে? হওয়ার কথা না।

আমার কাছে মনে হতো, এখানে এক এক জায়গায় বসে থাকা, নামাজ পড়া, তিলাওয়াত করার যেন এক এক রকম স্বাদ। রাসূল (স)-এর সময় তো মসজিদ এতো বড় জায়গা জুড়ে ছিল না, কিন্তু এই পুরো জায়গাটাই তো ছিল মসজিদের আশেপাশে। এসব স্থানে নিশ্চই পড়েছে আমার প্রিয় নবীজির পায়ের ছাপ! এসব জমিনে নিশ্চই ঘুরে ফিরেছেন আল্লাহর প্রিয়, নবীর প্রিয় সাহাবীরা। যুগ যুগ ধরে আল্লাহর সব প্রিয় বান্দাদের পা পড়েছে এসব মাটিতে, গুঞ্জন উঠেছে তাদের তিলাওয়াতের, জিকিরের, আল্লাহর বড়ত্বের আলোচনার; দরস হয়েছে কুরআনের, হাদিসের, ফিক্হের! তাই আমি ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো মসজিদ, এ মাথা থেকে ও মাথা, প্রতিটি কোণে, যতবেশি সম্ভব। কখনও নামাজে, কখনো তিলাওয়াতে, কখন দুআয়; কখনো শুধুই বসে থেকে, কখনো একটু বিশ্রামে। এরকম একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে আজব অভিজ্ঞতা হলো একবার। মসজিদে নববীতে মূল সবুজ গম্বুজ ছাড়াও আরও কিছু গম্বুজ আছে। প্রশস্ত এলাকা জুড়ে মাথার উপর ছায়া করে আছে নজর কাঁড়া কারুকার্য করা এসব গম্বুজ। একবার খুব সম্ভবত বেশ ভোরে, সূর্য তখনও বেশি উপরে উঠেনি। মসজিদের এরকম একটা গম্বুজের নিচে বসে আছি, আশেপাশে মুসল্লিরা তেমন কেউ নেই। ভাবলাম একটু লম্বা হই। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম কার্পেটের উপর, মাথার উপর বিশাল গম্বুজ। চোখ বন্ধ করতেই কখন যেন ঘুমিয়েই পড়লাম। ঘুম ভাঙলো কিছু পরে। চোখ খুলে আমি হতবাক, কোথায় আসলাম? ছিলাম শুয়ে গম্বুজের ছায়ায়, এখন দিকে মাথার উপর নীল আকাশ, গায়ে এসে পড়ছে দিনের আলো! একটু পরেই বুঝতে পারলাম বিষয়টা। এগুলো মসজিদের কিছু অত্যাধুনিক গম্বুজ। প্রতিদিন কিছু নির্দিষ্ট সময় আলো বাতাস প্রবেশের জন্য এগুলো নিঃশব্দে স্লাইড করে সরে যায় মসজিদের ছাদের উপর! আমার উপরেরটাও সেরকম সরে গেছে আমি ঘুমিয়ে থাকতে! সুবহানাল্লাহ!

এই মসজিদের কিছু জায়গা তো আছে অন্য সব অংশ থেকে স্পেশাল। 'জান্নাতের বাগানে' তো আল্লাহ চড়িয়েছেন সেই প্রথম রাতেই! এছাড়া রাসূল (স) এর রওজা শরীফের যে দিকে 'ক্বাদামাইন শারিফাইন' অর্থাৎ আল্লাহর হাবিবের মুবারক পা দুখানি, সে দিকের রওজার দেয়াল আর মসজিদের দেয়ালের মাঝে অল্প একটু জায়গা আছে। এখানেও ভিড় লেগে থাকে নামাজ পড়ার জন্য, অল্প সময় বসে আল্লাহর কাছে দুআ করার জন্য। এখানেও সময় কাটিয়েছি বেশ কিছুক্ষন। আরও আছে আসহাবে সুফ্ফার প্লাটফর্ম। নবীজির প্রিয় কত সাহাবী এখানে থেকেছেন আল্লাহর রাসূলের সোহবতে! (বর্তমান প্লাটফর্মটা অবশ্য তখনকার পজিশনে নেই, তার থেকে একটু পেছনে সরিয়ে নেয়া হয়েছে)

মসজিদের একেবারে সামনের অংশটা পুরোনো, তুর্কি আমলের। এই অংশে নামাজ পড়তেই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো, যদিও এখানে মুসল্লিদের ভিড় একটু বেশিই থাকে সবসময়। তবে যদি জানতে চান, পুরো মসজিদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা আমার কাছে কোনটি, তাহলে আপনাকে নিয়ে যাই এই পুরোনো অংশের আরেকটু পেছনের দিকে। মসজিদের মধ্যেই এখানে আছে একটা খোলা চত্বর। আর এখানেই বসে থাকতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো আমার। চারপাশে ঘিরে আছে মসজিদের দালান। সারি সারি পিলার আর আর্চগুলো চলে গেছে যেন দৃষ্টির সীমা পর্যন্ত, দুপাশে আর পেছনে। কাতারের লাল কার্পেটগুলো এখানেও বেছানো আছে মার্বেলের ফ্লোরের উপর। তবে মাথার উপরে ছাদ নেই, আছে খোলা আকাশ! আর সামনে? সামনেই মসজিদের তুর্কি আমলের, ভাব-গাম্ভীর্যে পূর্ণ পুরোনো অংশ। বামপাশে কোণাকুণি তাকালেই চোখে পরে রওজা শরীফের গাঢ় সবুজ দেয়াল, সোনালী জালি। আর ঠিক সেই বরাবর উপরে, নীল আকাশের গায়ে ঝলমল করছে সবুজ গম্বুজ! এরকম একটা পরিবেশের মাঝে বসে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে প্রিয় হাবিবের দেয়ালের দিকে, ওই গম্বুজের সবুজের দিকে।

প্রয়োজনে ছায়ার ব্যবস্থা আছে অবশ্য। উঁচু উঁচু পিলারগুলোর গায়ে লুকিয়ে আছে অত্যাধুনিক ছাতা। এই ছাতাগুলো ছড়িয়ে আছে মসজিদের বাইরের চত্বরেও। রোদ-বৃষ্টিতে প্রয়োজনে এসব ছাতা ছড়িয়ে যায় পিলার থেকে, আস্তে আস্তে খুলতে থাকে, মাঝ থেকে বাইরের দিকে। তবে খোলা অবস্থায় ছাতাগুলো সাধারণ ছাতার মতো বৃত্তাকার নয়, বরং চারকোণা। মসজিদের মাঝের এই চত্বরের ছাতাগুলো যখন মেলে দেয়া হয়, এদের কোণগুলো প্রায় মিলে যায় একটা আরেকটার সাথে, একেবারে মসজিদের ছাদ বরাবর। ছাতাগুলোর মাঝের ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যায় আকাশ। প্রযুক্তির ব্যবহার আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই। ছাতাগুলোর ডিজাইন মসজিদের আবহের সাথে মিশে যায় একেবারেই।

আর এই প্রিয় উন্মুক্ত চত্বরে, ছাতার নিচে একদিন পেলাম আরেকটা স্মরণীয় উপহার।

আসর পড়ার জন্য মসজিদে এসেছি। সেই ওয়াক্তে বাবা খুব সম্ভব বেশ ক্লান্ত ছিলেন, মসজিদে আসেনি। বাবার সাথে থাকলে তাকে নিয়ে এতটা ভেতরে আসতাম না, অনেক হাটতে হয় বলে। একা থাকলে আমি প্রায়ই নামাজে দাঁড়াতে চেষ্টা করতাম সামনের অংশের কোথাও। সেদিন দাঁড়ালাম এই খোলা চত্বরে। আকাশে মেঘ ছিল, সে জন্যই ছাতাগুলো পুরোপুরি মেলে আছে। জামাতের ইকামত হলো, নামাজে দাঁড়ালাম ছাতার নিচে। কিছুক্ষন পরেই শুনতে পেলাম শব্দটা, প্রথমে থেমে থেমে, অল্প অল্প। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো, বাড়তেই থাকলো। হ্যা, ছাতার উপর বৃষ্টির শব্দ! অল্প সময়ের মধ্যেই ঝুম ঝুম করে পড়তে শুরু করলো বৃষ্টি। ছাতাগুলোর মাঝের ফাঁকা দিয়ে বৃষ্টি আসছে মসজিদের ভেতর, ভিজে যাচ্ছে কার্পেট, ভেসে যাচ্ছে মার্বেলের মেঝে! আরেকটু পরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগলো ছাতার কাপড় চুয়ে চুয়ে। নামাজের মধ্যেই ভিজে যাচ্ছি বৃষ্টিতে! সুবহানআল্লাহ! সুবহানআল্লাহ! সুবহানআল্লাহ! আমাকে যদি চিনে থাকেন (যেটার সম্ভাবনা কম), বা আমার লেখা আগে পড়ে থাকেন (সম্ভাবনা নেই বললেই চলে), তাহলে নিশ্চয়ই জানেন বৃষ্টি আমার কত প্রিয়। আমার অন্যতম প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে কয়েকটা হলো বৃষ্টি দেখা, বৃষ্টির শব্দ শুনা আর বৃষ্টিতে ভেজা। কিন্তু কখনও কি কল্পনাও করেছি আমি ভিজবো এরকম এক জায়গায়? দাঁড়িয়ে আছি আল্লাহর হাবিবের মসজিদে, সামনেই প্রিয় নবীজির রওজা, সবুজ গম্বুজ; চলছে আসরের জামাত। একটু পর পর ইমাম সাহেবের গম্ভীর স্বরে তাকবীর, মুয়াজ্জিনের সুরেলা প্রতিদ্ধনি, আর সেই সাথে বৃষ্টির রিমঝিম। রহমতের পানি নামছে আকাশ থেকে, মসজিদে নববীর উপর ভেসে বেড়ানো, আল্লাহর পাঠানো মেঘ থেকে, এসে পড়ছে ছাতার উপর। এই ছাতা তো মসজিদেরই অংশ, মসজিদেরই ছাদ! রহমানের পাঠানো রহমতের বৃষ্টি, রহমতের নবীর মসজিদের ছাদ ফুঁড়ে এসে পড়ছে আমার মতো এক অযোগ্য বান্দার শরীরে! বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কিয়াম, রুকু; বৃষ্টি ভেজা মেঝেতে কপাল রেখে সিজদা! আল্লাহই জানেন, একমাত্র তিনিই জানেন, ওই মুহূর্তটা, ওই চার রাকআতের সময়টা আমার কাছে কত প্রিয় ছিল! হয়তো খুশির অশ্রু মিশেও গিয়েছিল বৃষ্টির পানির সাথে। নামাজ শেষ হতেই দেখা গেলো ছোটাছুটি, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সরে যাচ্ছে মুসল্লিরা, কার্পেট গুটানো হচ্ছে দ্রুত গতিতে। আমি বসেই থাকলাম অনেকক্ষণ। উঠে পড়লেই শেষ হয়ে যাবে এই উপহার, এই স্মৃতি। বৃষ্টি কমে এলো কিছু পরে। ততক্ষণে ভিজে গেছি ভালো মতো।

তবে উদ্ভট একটা দৃশ্যও দেখতে হলো এই সময়ে। এক মুসল্লি ভাই, দেখে মনে হলো আমাদের এই উপমহাদেশেরই কেউ হবেন নিশ্চই। পুরো নামাজ চলাকালীন সে বসে থাকলো, নামাজ না পড়ে। বৃষ্টির ফোঁটা যেখানে যেখানে পড়ছে, সেসব ফোঁটায় আঙ্গুল দিয়ে বৃষ্টির পানি নিজের চেহারায় মাখছে। নামাজ শেষে হওয়ার পরও সেই এই কাজই চালিয়ে গেলো অনেক্ষণ। দ্বীনের ক্ষেত্রে আবেগ বেশ উপকারি, এই আবেগের কারণে অনেক বাহ্যত কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়, প্রিয় হয়ে যায়। তবে এই আবেগও হতে হবে শরীয়তের দেখানো সীমার মধ্যে। তা না হলে সেটা আমাদের উল্টো পথে নিয়ে যেতে পারে সহজেই। এজন্যই দ্বীনের উপর চলা শিখতে হবে দ্বীনের বুঝমান আলেমদের থেকে, আল্লাহওয়ালাদের দেখানো পথে। উনারাই দেখিয়ে দিতে পারেন কিভাবে এই আবেগকে কাজে লাগাতে হবে জান্নাতের পথে এগোতে।

দ্বীনের ক্ষেত্রে সঠিক আকিদা, নিয়মনীতি, পদ্ধতি জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি আরেকটা জিনিস, যেটা আজকের যমানায় অনেক বেশি দুর্লভ। আর সেটা হলো আদব। দ্বীন সম্পর্কে যাদের এখনো বেশি জানার সুযোগ হয়নি তাদের কথা বাদই দিলাম, খোদ যেসব মানুষদের আমরা দ্বীনদার বলে মনে করি, তাদের ভেতরেও এই আদবের বড় অভাব আজকে। যাদের দিলে আল্লাহর আজমত, তাঁর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্বের একীন আছে, আছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মহব্বত, তারাই পারেন আল্লাহর ঘরের, নবীর রওজার আদব রক্ষা করতে। তাই আদব শিখে নেয়া দরকার আলেমে দ্বীনদের থেকে, আল্লাহওয়ালা বুজুর্গদের থেকে। এসব পবিত্র স্থানে তাদের আদবের নমুনা পেতে আবু তাহের মিসবাহ সাহেবের 'বাইতুল্লার মুসাফিৱ' পড়া যায়। কি অনুভূতি, কি আবেগ, কি শ্রদ্ধা, আদবের প্রতি কি পরিমাণ যত্নশীল হয়ে এসব স্থানে আসেন উনারা।

আর আদবের শিক্ষা না থাকলে কি হতে পারে তা স্বচক্ষে দেখতে হয়েছে আমাকে বহুবার, মক্কা ও মদিনায় ওই অল্প কয়েকদিনে। মসজিদের ভেতরের কথা বাদই দিলাম, একেবারে রওজা পাকের সামনে দাঁড়িয়ে চলছে গল্প, হাসাহাসি। ভিডিও হচ্ছে অনবরত, কেউ আবার সেলফি তুলছেন নবীজির রওজাকে পেছনে রেখে! খুব কষ্ট করে নিজেকে সামলে রাখতাম এসব দেখে দেখে। তবে মদিনা সফরের শেষের দিকের একবার যিয়ারতে একটু বেশি আবেগী হয়ে গিয়েছিলাম। সালাম পেশ করার জন্য এগিয়ে যেতে যেতে দেখতে লাগলাম মানুষের হাতে হাতে মোবাইল, চলছে ভিডিও, সেলফির অত্যাচার। কষ্টটা বাড়তে থাকে যত এগুতে থাকি সামনের দিকে। নবীজির রওজা শরীফের একেবারে কাছে যখন চলে এসেছি, তখন সামনে বেশ কয়েকজনের মোবাইল উঁচু করে ধরা, ছবি উঠছে। নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না আর। চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগলো। সামনের ভাইয়েরা অধিকাংশই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের। ভাঙা হিন্দি-উর্দুতে বলে উঠলাম কান্না নিয়ে, এখানে ছবি না উঠাই, সামনেই আল্লাহর রাসূল শুয়ে আছেন। বন্ধ করুন প্লিজ! আমার সামনেই ছিলেন খুব সম্ভবত পাকিস্তানী এক ভদ্রলোক, আমার চাচাদের বয়সী হবেন। ফটো তুলছিলেন তিনিও। আমার কথা শুনে ফিরে তাকালেন, খুব ঘাবড়ে গিয়েছেন। আমি বললাম, আমাকে ভুল বুঝবেন না। তিনি বললেন, না না, তুমি তো ঠিকই বলেছো! এরকম করা আমাদের উচিত না। খুব তাড়াহুড়ো করে ভদ্রলোক মোবাইলটা পকেটে ঢুকালেন। কিছু মানুষ এখনো আছে যারা সহজে ভুল স্বীকার করতে পারে। তবে এদের সংখ্যা খুব, খুব কম।

এভাবেই কেমন করে যেন চলে এলো বিদায়ের দিন। হায়, এই দিনেরই তো ভয়ে ছিলাম আমি, মদিনায় আমাদের প্লেন নামার পর থেকেই। এই দিনের ভয়েই তো চোখে পানি এসে গিয়েছিলো প্লেনের সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে! ভালো সময়, শান্তির সময়, সুখের মুহূর্তগুলো এতো দ্রুত কেন চলে যায়? সময়ের আপেক্ষিকতা কি একেই বলে? মদিনা থেকে যাবো মক্কায়, উমরার জন্য। একদিকে সফরের প্রস্তুতির ব্যস্ততা, অন্যদিকে উমরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি, বাইতুল্লাহর তাওয়াফের প্রতীক্ষা, এক্সাইটমেন্ট। তাই মদিনাকে বিদায় বলার কষ্টটা কিছুটা হলেও হয়তো কমে গিয়েছিল, সহনীয় হয়েছিল। মদিনা থেকে রওনা হওয়ার আগে প্রিয় নবীজির রওজায় শেষ যিয়ারতের সময় বাবার সাথে ছিলাম। দুজনেরই চোখ ভেজা! আবার কি আসব? সুযোগ হবে কি? এতো বড় সৌভাগ্য কি আবার আসবে জীবনে? এতো এতো উপহার কি আবারো আমাকে দিবেন আল্লাহ? বাবা মায়ের স্নেহের হাত ধরে, আল্লাহর রহমতের ছায়ায়, আবার কি আসা হবে নবীর মসজিদের মেহমান হয়ে?

আসবো, অবশ্যই আসবো ইনশাআল্লাহ। এই মসজিদে বসে বসে অনেক চেয়েছি এবার, আল্লাহ যেন আবার আনেন, বার বার আনেন, এখানেই যেন রেখে দেন! যেই আল্লাহ না চাইতে এতো দিলেন, তিনি চাইলে কি করে না দিয়ে পারবেন? অবশ্যই দিবেন। দিতেই হবে!


-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

লেখাটা যখন পোস্ট করছি, সেই unforgettable উমরার সফরের এক বছরেরও বেশি পার হয়ে গেছে। এবং ইনশাআল্লাহ আর মাত্র চারটি দিন পরেই রওনা হবো আবার! সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ এবছর আবারও ডেকেছেন তাঁর ঘরে, তাঁর বাইতুল্লাহর দরজায়, তাঁর হাবিবের দুয়ারে! উমরাহ নয় শুধু, একেবারে হজ্বের সফর! ইহরাম জড়িয়ে, লাব্বাইক বলে বের হয়ে যাবো ঘর থেকে! সাথে এবার আমার জীবনে নতুন এক মানুষ, আমার স্ত্রী! হজ্বের আহকাম, দ্বীনের শিক্ষা, আমল আর আদব এবার দেখে দেখে শিখবো আমাদের সফরসঙ্গী উলামা হজরতদের থেকে, বিশেষ করে আমার প্রিয় হজরত হামিদুর রহমান স্যারের কাছ থেকে। সুবহানআল্লাহ! আল্লাহর কাছে উপহারের এতো ভান্ডার? আবারো, এতো বড় করে খুলে গেলো আমার সৌভাগ্যের দরজা?  আল্লাহ তুমি অনেক বড়, অনেক প্রিয়, আমাদের তুমি অনেক ভালোবাসো!

বলেছিলাম না, আল্লাহ দিবেন? দিতেই হবে! বিশ্বাস হয় না? একবার চেয়েই দেখেন না চাওয়ার মতো।

বান্দা চাইলে, না দিয়ে তিনি পারবেন?


Friday, August 11, 2017

নূরের শহরে (৩) - আল্লাহর দুই বান্দা

মাসজিদুল হারাম আর মাসজিদে নববী। আল্লাহর আশিক যারা, আল্লাহর সন্তুষ্টি যারা খুঁজে ফেরেন, আল্লাহর হুকুমের যারা পাবন্দ, নবীর সুন্নাতের যারা অনুসারী; আল্লাহর প্রতি, আল্লাহর প্রিয় নবীর প্রতি ভালোবাসা যাদের অন্তরে বদ্ধমূল, পৃথিবীর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এমন বান্দারা প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন এই পবিত্র জমিনে। এই দুই শহরের আলো বাতাসে, এই দুই মাসজিদের ছায়ায় আসতে না পারলে তাদের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। অনেক বোকারা ভাবে, হজ্ব তো ফরজ একেবারই, এতবার যাওয়ার কি আছে? যিয়ারতের জন্য তো একদিনই যথেষ্ট, এতদিন মদিনায় কি দরকার? যাদের অন্তরে আল্লাহর মহব্বত নেই, যাদের কাছে ইসলাম মানে শুধুই কিছু নিয়মতান্ত্রিক কাজ, যেগুলো নিতান্ত বাধ্য হয়ে করতে হয়, তারা কী বুঝবে কাবার দিকে তাকিয়ে থাকার আনন্দ? যাদের কাছে নবীজি কেবলই একজন বার্তা বাহক, যাদের অন্তরে নেই আমাদের প্রিয় নবীর ভালোবাসা, নেই তাঁকে দেখার তামান্না, তারা কী বুঝবে যিয়ারতের জন্য ধীর পায়ে হেটে যাওয়ার সময় মনের অবস্থা? তাদের দিলে এসবের কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু যাদের দিলকে আল্লাহ তাঁর নিজ রহমতে সজীব রেখেছেন, সেখানে ঢেলেছেন তাঁর মহব্বত, তাঁর হাবিবের মহব্বত, তারা তো এখানে আসবেই! বার বার আসবে। তাই এই পবিত্র দুই আঙিনায় খুঁজে পাওয়া যায় আল্লাহর এসব প্রেমিকদের। যদি কেউ খুঁজতে চায়।

সেরকমই এক বান্দার দেখা পেয়ে গেলাম প্রথম দিনই। মাগরিবের নামাজের জন্য মাকে পৌঁছে দিয়েছি মহিলাদের নামাজের অংশে। আমি আর বাবা চলে এসেছি মসজিদের বেশ ভেতরের দিকে। মাগরিব আর এশার মধ্যে গ্যাপটা খুব বেশি না, তাই মাগরিব পরে মসজিদেই আমলে বসে থাকলাম। বাবার জন্য লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকা, বা মেঝেতে বসে থাকাও কষ্টকর। উনি বসে আছেন চেয়ারে, কুরআন তিলাওয়াতে ব্যস্ত। আমি বাবার পেছনেই বসে আছি, মাঝে মাঝে হাটাহাটি করছি। এমন সময় চোখ গেলো আমাদের থেকে কয়েক কাতার সামনের দিকে। হুইলচেয়ারে বসে আছেন একজন বয়স্ক লোক। একটু সামনে এগিয়ে ভালো করে দেখলাম। সাদা ধবধবে আপদমস্তক। মাথায় সাধারণ পাঁচ-কলি টুপি, গায়ে সাদা সুন্নতি লেবাস। পায়ের সালোয়ার 'নিসফে সাক' অর্থাৎ হাটু আর গোড়ালির মাঝ বরাবর। পুরোটাই ধবধবে সাদা। আর এমন উজ্জ্বলতা কখনও কি দেখেছি কারও চেহারায়? লালচে ফর্সা চেহারাটা ঢেকে আছে মুখভর্তি সাদা দাঁড়িতে। অসম্ভব সুন্দর, শান্ত সেই মুখ। মানুষটাকে দেখা মাত্রই একটা কথাই মনে হলো, ইনি আল্লাহর এক প্রিয় বান্দা। উনার সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে। আজব একটা আকর্ষণ আমাকে টেনে নিয়ে গেলো সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটার দিকে।

উনার আশেপাশে দেখলাম সুন্নতি লেবাসে কয়েকজন বসে আছেন, স্পষ্টতই তারা আমাদের আশেপাশের কোনো দেশের, এবং ওই মুরব্বির মুরিদ। পেছনে বসে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করলাম,

- উনি কি আপনাদের শায়খ?
- জি
- উনার পরিচয় ?
- উনি তো ফিরোজ মেমন সাহেব, হাকিম আখতার (র) এর খলিফা।

সুবহানাল্লাহ! ফিরোজ মেমন সাহেবের নাম তো আমি শুনেছি আগেই। আর পাকিস্তানের হজরত হাকিম মুহাম্মদ আখতার সাহেব (র) এর নাম না জানা কি সম্ভব? এখন তো তার সাথে হাত না মিলিয়ে যেতে পারবো না!

- আমি উনার সাথে মুসাফাহা করতে পারি ?
- অবশ্যই, কেন নয় ?

পেছন থেকে এগিয়ে গিয়ে হজরতের সামনে গিয়ে বসলাম, সালাম দিয়ে মুসাফাহা করলাম। অসম্ভব আন্তরিক একটা হাসি দিয়ে তার নরম হাতের মধ্যে নিয়ে নিলেন আমার হাত। কি প্রশান্তি ছিল উনার সেই হাসিতে, সেই মুসাফাহায়! হযরতকে পরিচয় দিলাম, বললাম আমার বাবা মায়ের সাথে এসেছি বাংলাদেশ থেকে। খুব খুশি হলেন। সেই সাথে ঢাকার কোনো একজন বড় আলেমের নাম বললেন, এখন মনে নেই, যার সাথে উনার খুব ভালো ইসলাহী সম্পর্ক। হজরতের কাছে দুআ চেয়ে ফিরে আসলাম আগের জায়গায়। এসেই বাবাকে বললাম, ঐ যে উনি একজন আল্লাহওয়ালা, পাকিস্তানের বুজুর্গ ব্যাক্তি। উনার এপিয়ারেন্স বাবাকেও মুগ্ধ করেছিল। বাবা বললো, চল সালাম দিয়ে আসি। বাবাকে নিয়ে গেলাম হজরতের কাছে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হজরত তার হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাবার সাথে মুসাফাহা করলেন, শরীর-স্বাস্থ্যের খবর নিলেন, বিনয়ের সাথে। দুই মুরব্বির হাসিমাখা মিলনের দৃশ্যটা খুবই সুন্দর ছিল। একটু পরে বাবা বললেন, এটা আমার ছেলে, কিছুদিন পর ওর বিয়ে ইনশাআল্লাহ, ওদের জন্য বিশেষ দুআ চাই। হজরত খুশি হয়ে আমার দিকে ফিরলেন, দুআ করলেন। সুবহানাল্লাহ! যার বিয়ে তার নিজের তো খবর ছিল না এব্যাপারে দুআ চাইতে, অথচ বাবার মাথায় ঠিকই ছিল। আসলে বাবা-মায়েরা এমনই হয়। ছেলে মেয়েদের ভালো থাকা, খুশি থাকা নিয়ে চিন্তা তাদের মাথা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরে যায় না।

رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

আল্লাহর আরেক আশেক বান্দা, দ্বীনের এক একনিষ্ট খাদেম, আমার অসম্ভব প্রিয় এক ব্যক্তিত্বের সাথেও আল্লাহ মিলিয়ে দিয়েছিলেন তার পরের দিনই। যোহরের নামাজের পর মসজিদ থেকে বের হচ্ছি। হোটেলে ফিরে যাবো, আমাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কোন দরজা দিয়ে বের হচ্ছিলাম সেটা এখন মনে নেই। গেটের বেশ কিছু দূর থেকেই গেটের কাছে কয়েকজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, কথা বলছেন। এতদূর থেকে চেহারা স্পষ্ট না দেখা গেলেও, একজনের অবয়ব পরিচিত মনে হলো। হ্যা সেরকমই তো পোশাক, চোখে চশমা, দাড়িও সেরকম হালকা লালচে। মাঝারি গড়নের, যেমনটা দেখেছিলাম আগে একবার। উনি কি তবে.......???

Bucket List এর সাথে পরিচিত আছেন? জীবনে আপনি কি কি করতে চান, মৃত্যুর আগে? পৃথিবীর কোন কোন সৌন্দর্য আপনি ঘুরে দেখতে চান? কি ধরণের adventurous কাজ করতে চান, অন্তত একবার হলেও? এরকম টার্গেটের লিস্টকে Bucket List বলে। আমার এরকম একটা লিস্ট আছে। জীবনে অন্তত একবার হলেও, যেসব মানুষের সাথে আমি সাক্ষাৎ করতে চাই, কথা বলতে চাই, এরকম মানুষদের একটা লিস্ট। এই লিস্টে আছেন এমন কিছু মানুষ, যাদের influence আমার জীবনে অনেক। যাদের লেখনী, যাদের লেকচার আমার নিজের মানসিকতা গঠনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে আমার দ্বীনী understanding, দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে আমার concept, অর্থাৎ বুঝ-সমঝের ক্ষেত্রে এসব মানুষের অবদান অনেক। দ্বীন মানা এক জিনিস, আর দ্বীনের বুঝ অন্য জিনিস। আর এই দ্বিতীয়টার গুরুত্ব অনেক বেশি। যেসব দ্বীনি ব্যক্তিদের কথা, লেখা আমাকে শিখিয়েছে কুরআনের শিক্ষা, হাদিসের শিক্ষা, তাদের কাছে আমি চির ঋণী। আর উনাদের তালিকায় একেবারে প্রথম দিকেই যার নাম, তিনি মুফতি ত্বকী উসমানী।

বর্তমান সময়ে যারা দ্বীনের উপরে কিছুটা হলেও চলার চেষ্টা করছেন, শেখার চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যে মুফতি ত্বকী সাহেবকে চেনেনা এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। উনার কেবল পরিচয় তুলে ধরতেও কয়েক পৃষ্ঠা লেগে যাবে। দ্বীনের কোন শাখায় নেই উনার কন্ট্রিবিউশন? একদিকে উনি ফিকহ এবং হাদিসের অনেক বড় উস্তাদ, পড়াচ্ছেন দারুল উলুম করাচিতে। ইসলামী অর্থনীতিতে তিনি সারা পৃথিবীতে একজন লিডিং রিসার্চার। উনার সম্মানিত পিতাও ছিলেন সারা দুনিয়ায় সুপরিচিত একজন আলেমে দ্বীন, মুফতি শফি উসমানী (র)। বাপকা বেটা যাকে বলে। মুফতি ত্বকী সাহেব হাদিসের সনদ পেয়েছেন যাদের থেকে তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন শায়খ যাকারিয়া (র), মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী (র), ক্বারী তৈয়ব সাহেব (র) এবং মাওলানা সলিমুল্লাহ খান (র)। এখানেই শেষ না। তাজকিয়ার মেহনতেও আছেন প্রথম সারিতে। হাকীমুল উম্মাত আশরাফ আলী থানভী (র)-এর দুজন বিশিষ্ট খলিফা ড. আব্দুল হাই আরিফী (র) এবং মাওলানা মাসীহুল্লাহ খান (র) এর খেদমতে থেকে সুলূকের পথে হেঁটেছেন। দুজনের থেকেই খিলাফত লাভ করে আত্মশুদ্ধির পথ দেখাচ্ছেন অগণিত মুসলিমদের, যারা উনার হাতে বায়আত হয়েছেন। এসব দ্বীনি ব্যস্ততা সত্ত্বেও আইনে পড়াশোনা করেছেন, পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছেন! এছাড়া লিখেছেন আশিটিরও অধিক দ্বীনি কিতাব; উর্দু, ইংরেজি এবং আরবি ভাষায়। সুবহানাল্লাহ! একেই বলে বরকত। আমার দ্বীনি বুঝ-সমঝ গঠনে উনার বয়ান, লিখিত বই এবং প্রবন্ধের ভূমিকা অনেক বেশি। কয়েক বছর আগে উনার একটা বয়ান সরাসরি সামনে বসে শুনার তৌফিক হয়েছিল ঢাকায়। অল্প সময়ের সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো এখনো গেথে আছে আমার মন-মস্তিষ্কে, আশা করি থাকবে সারা জীবন। তবে সেবার উনার সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি, তাই একটা আফসোস ছিল মনে মনে।

গেটের আরেকটু কাছে যেতেই আর সন্দেহ থাকলো না। দাঁড়িয়ে আছেন মুফতি ত্বকী উসমানী সাহেব! সাথে আরো দুই জন। অনেকটা মন্ত্র মুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। হজরত খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে কথা বলছিলেন বাকিদের সাথে, চেহারার এক্সপ্রেশন খুবই সিরিয়াস। তারপরও সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। দুহাতে মুসাফাহা করলেন হজরত, সালামের উত্তর দিলেন। ইচ্ছা হচ্ছিলো কিছু কথা বলতে, দুআ চাইতে, কিন্তু আমি ঢুকে পড়েছি তাদের conversation এর মধ্যে, তাও বেশ সিরিয়াস বিষয়ে নিশ্চয়ই। তাই আর দেরি করলাম না, প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনাদের ছেড়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। আল্লাহর দেয়া হঠাৎ এই সুযোগ বিশ্বাস করতেও সময় লাগলো কিছুক্ষণ। আমি আসলেই মুফতি ত্বকী সাহেবের সাথে হাত মেলালাম? আলহামদুলিল্লাহ। সেই সাথে আবার আফসোসও হলো, এতো কাছে এলাম, মুসাফাহা হলো, কিন্তু কথা হলো না, দুআ চাওয়া হলো না? মিশ্র একটা অনুভূতি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

কাহিনী এখানেই শেষ হলেও সেটা হতো অন্যতম স্মরণীয় একটা ঘটনা। তবে এই গল্পের ২য় পর্ব যে এখনো বাকি, সেটা আমি কিভাবে জানবো?

এশার নামাজ পড়লাম মসজিদের পুরোনো অংশে, অর্থাৎ একেবারে সামনের দিকে। বাবুল সালাম থেকে বাবে বাকি'র দিকে যিয়ারতের যে রাস্তা, তার ঠিক পেছনে সারি সারি শেলফ আছে সোনালী রঙের, কোরআনের মুসহাফ রাখা। এরকমই একটা শেলফের পেছনে এশা পড়লাম। জামাত শেষ হলো, সুন্নতের জন্য দাঁড়ালাম একটু দেরি করেই। তখন জায়গায়টায় মুসল্লিদের চাপ কমে গেছে অলরেডি। আমার দুপাশে কেউ নেই। বিতর নামাজ পড়ছি, ঠিক পাশেই একজন এসে দাঁড়ালেন নামাজে। ভদ্রলোক যখন রুকুতে গেলেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার এপিয়ারেন্সের দিকে নজর গেলো। কি ব্যাপার? মনে তো হচ্ছে ...... । সালাম ফিরিয়ে ঝট করে পাশে তাকালাম। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। আমার ঠিক পাশে নামাজ আদায় করছেন শায়খ ত্বকী উসমানী! এতটা সৌভাগ্য আমার কপালে কিভাবে জুটলো? এতো বড় মসজিদে নামাজ পড়ার জায়গার কোনো অভাব নেই। আমার প্রিয় মানুষটা এসে দাঁড়ালেন ঠিক আমারই পাশে?

হজরতের নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলাম। উনার ব্যাপারে একটা কথা আগেই শুনেছি কার কাছে যেন। মা'মুলাত অর্থাৎ নিয়মিত আমলের ব্যাপারে উনি এতটাই punctual, যেন আমলটা তখন না করলে আর করাই হবে না। আমলের দিকে এমনভাবে ছোটেন, যেন ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। ব্যাপারটা এবার দেখতে পেলাম স্বচক্ষে। নামাজের সালাম ফেরানোর সাথে সাথেই এক হাত বাড়িয়ে দিলেন সামনের শেলফে, কোরআন হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলেন। এবার আমাকে একটু স্বার্থপর হতেই হলো। ভাবলাম যা করার উনি তিলাওয়াত শুরু করার আগেই করতে হবে। সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। নিজের পরিচয় দিলাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে হজরত খুশি হলেন। এরপর দুআ চাইলাম। দুটো স্পেশাল দুআ চাইলাম, হজরত আমিন বললেন! সেই সাথে হজরত নিজে থেকেই আরও কিছু দুআ করতে লাগলেন। হাসি হাসি মুখে কি দুআ করছিলেন হজরত, আমি ভালো করে শুনতে পাইনি, খুশির একটা ঘোরের মধ্যে কেবল বলে যাচ্ছিলাম, আমিন! আমিন! আমিন! দুআ শেষ করেই হজরত হাতে থাকা কোরআন খুলে বসলেন, ট্রেনটা ছুটেই যায় কিনা। এবার আর বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না ভেবে উঠে এলাম। যাওয়ার পথে ফিরে ফিরে দেখছিলাম শায়খকে, চোখে তখনও অবিশ্বাস। এরকম একজন মানুষের সাথে দেখা হবার, দুআ চাওয়ার সুযোগ কিভাবে পেলাম? মসজিদের এতো দরজা থাকতে, আমরা কিভাবে একই গেটে একত্রিত হলাম দুপুরে? আবার ঐদিনই এশার পরেই, এই সুবিশাল মসজিদের এতো জায়গা থাকতে, কিভাবে ঠিক পাশাপাশিই আল্লাহ দাঁড় করালেন আমাদের? আল্লাহ তাআলা যেন বুঝিয়ে দিলেন, আল্লাহ যদি দিতে চান, তিনি কারও যোগ্যতার পরোয়া করেন না। যোগ্যতা ছাড়াও তিনি দেন, চাইলেই দেন। আবার কখনো না চাইতেও দেন। আল্লাহর রহমতের কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। আমার মতো অলস, অযোগ্য, অপদার্থ বান্দাকেও আল্লাহ এতটা ভালোবাসতে পারেন, কাছে টানতে পারেন, উপহার দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারেন! কিভাবে করবো এর শুকরিয়া? কিভাবে আল্লাহকে জানাবো কৃতজ্ঞতা? ভাষা নেই। শুধু সেই শব্দগুলো ছাড়া, যা তিনিই শিখিয়েছেন তাঁর বান্দাদের .....
الْحَمْدُ لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

---------------------------------------------------------------------------------------------------